দখিনের খবর ডেক্স ॥ দিনের পর দিন পলি পড়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা ও গভীরতা হারাচ্ছে দেশের নদীগুলো। প্রতি বছর দেশের নদ-নদীতে গড়ে জমা পড়ছে ৪ কোটি টন পলি। ফলে নৌপথছোট হয়ে আসছে। গত ৪৭ বছরে নৌপথের দৈর্ঘ্য কমেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার। স্বাধীনতার আগে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার, এখন তা কমে মাত্র ৫ হাজারেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। খননের অভাবে পদ্মা নদীও এখন ধু-ধু বালুচর। পাশাপাশি দেশজুড়েই অব্যাহত রয়েছে নদী দখল ও দূষণ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভাটির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোতে প্রতি বছর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ঘনমিটার পলি প্রবাহিত হয়। আর তার বড় অংশই নদীর তলদেশে জমা হয়ে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করছে। ৪৭ বছরে নদীগুলোতে পলি জমেছে প্রায় ১৭৮ কোটি টন। পলির কারণে ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ নদী। অধিক হারে পলি জমা, সংরক্ষণে অবহেলা, অবকাঠামো নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, জলবায়ু পরিবর্তন, খনন যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিগত ১৯৬০ সালে ঢাকায় জলভাগের তুলনায় নগরায়িত স্থলভাগের পরিমাণ প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ অনুপাত ৪ গুণ কমে গেছে। ঢাকার চারপাশ ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প-কারখানাসহ অন্য শিল্পবর্জ্যে ভরাট হওয়ার পথে বুড়িগঙ্গা নদী। আর নাব্যতা সংকটে বালু নদেও নৌযান চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। ৩৬ কিলোমিটার ওই নদের ২২ কিলোমিটারই অবৈধ দখলে। নদটি ড্রেজিংও হয় না। তুরাগ নদ দখল ও দূষণে সরু খালে পরিণত হয়েছে। তবে বর্তমানে এই চার নদ বাঁচাতে ওয়াকওয়ে ও বনায়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। বর্তমানে দেশের অধিক বিপদাপন্ন ২৮টি নদীর মধ্যে ঢাকার চার নদী ছাড়াও সিরাজগঞ্জের বড়াল, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ডাকাতিয়া, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির কর্ণফুলী, নেত্রকোনার মগরা ও সোমেশ্বরী, খুলনার ময়ূর, হবিগঞ্জের খোয়াই, রংপুরের ঘাঘট, সিলেটের পিয়াইন; চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার নবগঙ্গা, টাঙ্গাইলের লৌহজং, বান্দরবানের শঙ্খ, কক্সবাজারের বাঁকখালী, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, দিনাজপুরের পুনর্ভবা, বগুড়ার করতোয়া, সাতক্ষীরার আদি যমুনা, নওগাঁ ও জয়পুরহাটের ছোট যমুনা, কুড়িগ্রামের ধরলা ও সোনাভরি, বরিশালের সন্ধ্যা, ফরিদপুরের কুমার, নাটোরের নারদ ও যশোরের কপোতাক্ষ নদের নাম রয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের ৬৪ নদীর মধ্যে ৩৭টি এখন অস্তিত্বহীন। নাব্যতা হারিয়েছে বরগুনা, নয়াভাংগনী, সাতলা, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া ও ইলিশা নদী। তবে ৫০ বছর আগের মানচিত্র ধরে অভিযান চালালে নৌপথকে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র আরো জানায়, দেশের নদ-নদী রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, ডিসিসিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা গত ১০ বছরে প্রায় ৪০ দফা অভিযান চালিয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা। দখলদারদের মামলা, গ্রেফতার, জরিমানাসহ নানা রকম শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএর অধীনে থাকা ৫৩ নৌপথের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে ওসব নদীর খনন শেষ হবে। সেজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রথম পর্যায়ে ২৪ নদীর ৯২০ কিলোমিটার খনন করা হবে। খননকৃত পলি নদীতে না ফেলে ড্রেজিং-সংলগ্ন এলাকায় নির্দিষ্ট জমিতে পলি ফেলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণেও নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে। বিঘœ ঘটছে নৌপথের স্বাভাবিকতা। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে গতিপ্রকৃতিও। ফলে দুর্ঘটনায় পড়ছে নৌযান। নদ-নদীর স্বাভাবিক গতি রক্ষায় নৌপরিবহন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা প্রয়োজন বলে তারা দাবি করেন।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক জানান, বর্তমান সরকার নৌপথ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তাছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এলজিইডিÍ ওই তিনটি সংস্থার অধীনে পৃথকভাবে নদী সংস্কার কার্যক্রম চলছে।
Leave a Reply